Sunday, September 9, 2018

চা – কফি

যেভাবে শখে শখে ব্যাপারটা পরিণত হল নেশায়
আমরা ছোট বেলায় যে বাসায় ভাড়া থাকতাম, ঐ বাসার বাড়িওয়ালা নানু ছিল ইংলিশের টিচার। উনার তিন ছেলের মাঝে বড়টা ছিল মেরিনে, আর ছোট দুইটা ছিল ক্যাডেটে। উনি প্রতিদিন বিকালে স্কুল থেকে ফিরে খাতা দেখতেন অথবা স্কুলের কোন কাজ করতেন। আর ঐ সময় আমি দুপুরে খেয়ে – ঘুমিয়ে, ঘুম থেকে উঠে উনাদের বাসায় বেড়াতে যেতাম। উনি খুব আদর করতেন। উনি কাজ করার সময় চা খেতেন, আর আমাকে পাশে বসায় রাখতেন। মাঝে মাঝে কাজের মহিলাকে বলত, আমাকেও যেন চা দেয়। আমার তখন ৩/৪ বছর হবে। আমি ঐ সময় থেকেই চামচ দিয়ে চা খাওয়া শুরু করি।
অন্যদিকে, আমরা কুমিল্লা বেড়াতে গেলে, নানা ভাই আমাকে সাথে করে বাজারে নিয়ে যেতেন। উনি ছিলেন একই সাথে ব্যাবসায়ি এবং পলিটিশিয়ান। সুতরাং, উনার বেশিরভাগ সময় যেত লোকজনের সাথে কথা বলে আর চা খেয়ে। আমিও নানা ভাইয়ের সাথে বাজারে গিয়ে প্রিজে করে চা নিয়ে খেতাম।
তারপরের ঘটনা ২০০২ এর শুরুর দিকে হবে। তখন ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠলাম মাত্র। আব্বু তখন শারীরিক অসুস্থতা কাটিয়ে ভালোর দিকে। নিয়মিত অফিস যাওয়া আসা এবং দৌড়া দৌড়ী শুরু করেছে। একদিন দুইটা বয়াম নিয়ে আসলো। একটা ছিল ন্যাস্কেফে কফি, অন্যটা ক্রিমার। সেই থেকে শুরু হয়ে গেলে কফি খাওয়া। মাগরিবের নামাজ পড়ে, নাস্তা করে, কফি বানাতাম, তারপর পড়তে বসতাম। নিয়মিত রুটিন।
ভার্সিটিতে এসে এমন এক গ্রুপের সাথে চলাফেরা, যারা সব সময় ডিপার্টমেন্টের চিপায় থাকতো। প্রতি ক্লাসের আগে এবং পরে, ল্যাবের আগে এবং পরে, সকালে এসে এবং যাওয়ার আগে, এর মাঝে টিএসসি – কলা ভবন – নীলক্ষেত –আজিজ মার্কেট, যেখানেই যাওয়া হোক সেখানে গিয়ে, অলটাইম চা খায় সবাই। একদিন আমি আর তনু রাতের বেলা হিসেব করে দেখলাম, আমরা ঐ দিন ২২ কাপ চা খাইসি! অন্যান্য দিনও গড়ে সেটা ১৫ এর কম হবে না।
পিএইচডি লাইফে সব চেয়ে বেশি খাওয়া জিনিসের নাম – কফি। সবার মাঝে এই ধারণা ঢুকে গেছে যে, অন্য কোন কারণে ডাকা হলে, আমি যাই বা না যাই, কফি খেতে ডাকা হলে, আমি উপস্থিত। ইউনিভার্সিটি গেটের কাছের সেভেন-ইলাভেনটা মোটামুটি একটা আড্ডাখানায় পরিণত করা শেষ। দরজা দিয়ে আমরা ঢুকলেই কাউন্টারে দাঁড়ানো যে কেউ আমাদের মাথা গুনে স্টেরিওফোম কাপ নিয়ে রেডি হয়ে থাকে। আর পরিচিত সবাই গত কয়েক বছরে এতো কফি গিফট দিসে যে, আমি প্রায় টানা দেড় বছর কফি কিনি নাই। বার্থ ডে তে কফি দেয়, নিউ ইয়ারে কফি দেয়, কনফারেন্সে গেলে অথবা ঘুরতে গেলে সবাই এনে কফি দেয়।
এখন রমজান চলে। কফি খাওয়ার টাইম একদম নাই বললেই চলে। ইফতার করেই, কিছুক্ষণ পর তারাবী। তার কয়েক ঘণ্টা পরেই সেহরি। মসজিদে ইফতারের সময় এতো খাওয়া হয় (অন্যভাবে বললে পারফর্ম করা হয়) যে, তারাবীর সময় মনে হয় ঘুমে পড়ে যাবো। আজকে ইফতারের পর একটা নাইজেরিয়ান ফ্রেন্ড আছে, সোলেমান, ওরে বললাম চলো, কফি খেয়ে আসি। নাইলে ঘুমায় পড়বো তারাবীর সময়। গেলাম দুইজন। আর সোলেমান হল মোটামুটি জীবন্ত উইকি পেজ। যে কোন টপিক আসলেই, সেটা নিয়ে সে জানে না এমন কিছু নাই। দেখা গেল বক বক করতে করতে কফি খেয়ে এসে নামাজে আজ ভালো কাজ দিছে। সে প্রতি দুই রাকাত পর পর সালাম ফিরিয়ে আমার দিকে তাকায়, আর বলেঃ “ইট’স ওয়ারকিং”।
আর এই বিরাট বর্ণনাটা হল মসজিদ থেকে ফিরে আসার পথে ১৫-২০ মিনিটের ভাবনা। কিভাবে ৩ বছরের এক পিচ্চি শখের ছলে চা – কফি খেতে খেতে একটা সময় এই সামান্য পানীয় জীবনের সব কিছুতে জড়িয়ে গেছে বললে ভুল হবে, জীবনের সব সম্পর্ক আর আবেগ চা – কফিতে ডুবিয়ে দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment