Sunday, September 9, 2018

আচমকা ইবাদত

স্কুলে থাকতে পরীক্ষা আসলে আমাদের নামাজ কালাম পড়া খুব বেড়ে যেতো। আব্বু এটা নিয়ে খুব হাসাহাসি করত। আর তার ছোট বেলার এই সংক্রান্ত গল্প বলত।
স্বাধীনতা যুদ্ধের আগের কথা। আব্বু তখন অনেক ছোট। খেলাধুলা করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরার পথে একটা জঙ্গলের মতন ছোট ঝোপ-ঝাড় পার হয়ে আসা লাগতো। অনেকেই বলত সেখানে ভূত আছে। তারা সবাই বিশ্বাসও করত। ঐ পথ ধরে আসার পথে সবাই নিজস্ব ভাণ্ডারে থাকা সূরা কালাম পড়তো। তাদের মাঝে একজন, হামিদ, সে এক ডিগ্রি বেশি ছিল। সে দোয়া কালাম পড়ার পাশাপাশি বলতে থাকতোঃ
"আল্লাহ আজকে ভালো ভাবে পার করে দাও, মসজিদে টাকা দিবো।"
এভাবে দিনের পর দিন যায়, কিন্তু হামিদ কখনোই মসজিদে টাকা-পয়সা দেয় না। তার সাথের অন্যরা জিজ্ঞেস করলোঃ
"কিরে? তুই প্রতিদিন জঙ্গল দিয়ে আসার সময় ওয়াদা করিস মসজিদে টাকা দিবো, কখনো টাকা দিস না যে।"
সে উত্তর দিতোঃ
"আমি টাকা দিবো কেন? আল্লাহ আমাকে ভয় দেখাইছে, আমি আল্লাহকে লোভ দেখাইছি!"
হামিদ আঙ্কেল হয়তো ঐ বয়সে ভাবতো যে, আল্লাহ তার চালাকি বুঝতে পারে না।
গল্পটা হাসির। কিন্তু, আমরা সবাই কি আসলে ঐ হামিদের এক একটা প্রতিচ্ছবি? যখন বিপদ-আপদ-ঝামেলা-অসুখ আসে, তখন আল্লাহ ভক্তি বেড়ে যায়। যখন দিনকাল ভালো যায়, নিজের মত চলাফেরা করি।

আবদুল মোনেম লিমিটেড

বাসায় আমি কোক খাওয়ার একটু পরেই আম্মু আমাকে দাঁত ব্রাশ করতে পাঠাইত। বলত যেঃ "কোক খাইলে দাঁত কালো হয়ে যায়!"
এই প্রসঙ্গে আব্বু বলতঃ "আবদুল মোনেম লিমিটেড একই সাথে কোক ও বানায়, আবার রাস্তা ও বানায়। বলা যায় না, রাস্তার কালো পিচ তুলে কোক বানানোর সময় দিয়ে দিতে পারে!"

শয়তানে লারে চারে

ছোটবেলায় সন্ধ্যায় পড়তে বসলে নিয়ম করে কারেন্ট যেতো। ঐ সময় আম্মু মোম জ্বালায় দিতো অথবা হ্যারিকেন। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মোম নিয়ে বিরাট দুষ্টামি চলতো। এক মোম দিয়ে আরেক মোমের মাঝে গলাতাম, মোম গলিয়ে গলিয়ে স্ট্যাচু বানাতাম। আম্মু একটু পর পর এসে দেখত কি করতেছি। এই রকম অপকর্ম করা অবস্থায় দেখতে পেলে, পিছন থেকে পিঠের উপর একটা থাপ্পর দিয়ে বলতঃ
"শয়তানে খালি লারে চারে?"
বড় হয়ে যাওয়ার পর, এখনও মাঝে মাঝে "শয়তান লারে চারে"। মনে হয়, আম্মু এসে যদি একটা পিঠের উপর থাপ্পর দিয়ে দিতো, তাহলে আবার ট্র্যাকে ফেরত আসতাম।

ইকো - নারসিয়াস

গ্রীক মিথোলজির কিছু গল্প অত্যন্ত শিক্ষণীয়। এর মধ্যে ইকো আর নারসিয়াসের গল্পটা সবচেয়ে বেশি ইন্টারেস্টিং মনে হয় আমার কাছে।
ইকোর কাজিনদের সাথে জিউসের প্রেম ছিল। জিউস তাই গোপনে ইকোর কাজিনদের সাথে দেখা করতে বনে-জঙ্গলে যেতো। আর সেই সময় পাহারা দেয়ার কাজ করত ইকো। একদিন জিউসের বউ, হেরা, ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরে, জিউসকে হাতেনাতে ধরার জন্য বনের দিকে যেতে থাকে। ঐ সময় ইকো হেরার সাথে গল্প-গুজব করে তার পথ আগলে রাখে। এই সময়ের মাঝে জিউস পালিয়ে যায় হেরার উপস্থিতি বুঝে। আর হেরাও জিউসকে হাতেনাতে ধরতে পারে না। কিন্তু, হেরা বুঝতে পারে ইকো’র কারসাজি। সে ইকোকে অভিশাপ দেয়। অভিশাপটা ছিল এরকম, ইকো নিজের থেকে কোন কথা বলতে পারবে না। শুধু মাত্র কেউ তার সামনে কোন কিছু বললে, সে সেটা রিপিট করতে পারবে।
দুঃখে ইকো বনে চলে যায়। বনে গিয়ে সে দেখা পায় সুদর্শন নারসিয়াসের। নারসিয়াস নিজেও জানতো না সে দেখতে কতোটা সুদর্শন। বরং, তার প্রতি মানুষের অমায়িক ব্যাবহার দেখে সে বুঝতে পারতো না, সবাই তার সাথে এতো ভালো ব্যাবহার করে কেন? যেহেতু, ইকো নিজের থেকে কিছু বলতে পারতো না, তাই সে গোপনে সব সময় নারসিয়াসকে ফলো করতো। তো নারসিয়াস একদিন নদীতে পানি খেতে গিয়ে নদীর জলে নিজের মুখ দেখে বিমোহিত হয়ে যায়। সে ভাবতে থাকে, এই সুদর্শন লোকটা কে? সে জিজ্ঞেস করেঃ “তুমি কে?” এই সুযোগে ইকোও আড়াল থেকে বলেঃ “তুমি কে?” নারসিয়াস বিরক্ত হয়। কে তার কথা রিপিট করছে এই ভেবে। নারসিয়াস যখন সেই লোকটাকে ধরতে যায়, তখন সে হারিয়ে যায়। কিন্তু এক দিকে নারসিয়াস জলের মাঝে যেই মুখ দেখা যায় তার প্রেমে পড়ে যায়, আর অন্য দিকে ইকো পড়ে থাকে নারসিয়াসের প্রেমে।
দিনের পর দিন এই ভাবে নদীর ধারে বসে থাকতে থাকতে নারসিয়াস শুকিয়ে যায়, রোগা হয়ে যায়। কিন্তু, তারপরও সে ঐ জায়গা থেকে অন্য কোথাও যায় না। অন্য দিকে, ইকো বুঝতে পারে নারসিয়াস অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে তো কথা বলতে পারবে না। এমন করেই চলতে থাকে। একটা সময় নারসিয়াস মারা যায়। আর সে ফুল হয়ে ভেসে যায় নদীর জলে। অন্যদিকে, ইকো নারসিয়াসের প্রেমে পড়ে গোপনে তাকে দেখতে দেখতে সেও মারা যায় এক সময়, আর সে মিশে যায় বাতাসে প্রতিধ্বনি হয়ে।
শিক্ষণীয় ব্যাপার হল, নারসিয়াস যেমন নিজের প্রেমে পড়ে সব কিছু ভুলে গিয়ে এক সময় মৃত্যু বরন করে, তেমনি ইকোও নারসিয়াসের প্রেমে পড়ে সব কিছু ভুলে গিয়ে এক সময় মারা যায়। এই ধরনের ক্যারেক্টার আমাদের মাঝে আজও দেখা যায়। এক ধরনের লোক আছে, যারা সারাক্ষণঃ “আমি এটা করেছি, আমার এটা আছে, আমি এটা পারি, আমি এখানে গিয়েছি”, এই রকম “আমি-আমি” করতে করতেই জীবন শেষ করে দেয়। আর এক ধরনের লোক আছে, যারা সারা জীবন নিজের থেকে কিছু বলতে ও করতে পারে না, শুধু মাত্র অন্য কারো “প্রতিধ্বনি” হয়ে বেঁচে থাকে। আর পুরোটা জীবন অন্য কাউকে ফলো করতে করতে কাটিয়ে দেয়।
Based on the book “Gods and Goddesses in Greek Mythology” by Michelle M. Houle

বিশ হাজার রিড

প্ল্যান্ট সায়েন্স নিয়ে ব্লগিং করতেছি ৩ বছর হল। এই বছর তিনেকে মোট পোস্টের সংখ্যা ৬৬, আজকে পর্যন্ত। আর অন্য একটা মাইল ফলকে পৌছে গেছি আজকে। মোট ২০ হাজার রিড। যারা সায়েন্স নিয়ে লেখালেখি করে, তাও আবার খুব ন্যারো ফিল্ডে, তাদের খুব ভালোভাবেই ধারণা আছে তিন বছরে ২০ হাজার রিড কোন ধরনের অর্জন।
এই লেখালেখি শুধু নিজেকে ডেভোলপ করতে সাহায্য করে না শুধু, পাশাপাশি অনেক পরিচিতি এনে দেয় যেটা কল্পনার বাইরে। কিন্তু, কোন কাজ ভালো লাগলে, আর তাতে ধীরে ধীরে ভালো করলেই শেষ না, সেখান থেকে উপার্জনের ব্যাবস্থা করতে না পারলে সেটা নিয়ে ভবিষ্যতে খুব বেশি দূর যাওয়া যায় না (please read about “The Hedgehog Concept” from the book “Good to Great” by Jim Collins)। গেস্ট সায়েন্স রাইটার হিসেবে প্রতি আর্টিকেল অথবা পোস্টে ১০ ডলার থেকে শুরু করে ৫০ ডলার পর্যন্ত চলে আসে।
আজ থেকে প্রায় ৫/৬ বছর আগে প্রথম ব্লগিং এর ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হই আমার ল্যাবের বড় ভাইয়া, Samsad ভাইয়াকে দেখে। তারপর বন্ধু Arafat ছিল অন্যতম প্রেরনার উৎস। সে নিয়মিত বিজ্ঞান ব্লগে লেখালেখি করত, এখনও করে। বায়ো-বায়ো-১ এর সাথে সম্পৃক্ততার কারণে অনলাইনে বাংলায় কোর্স আর তার মেটেরিয়াল তৈরি করতে গিয়েও অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে।
সব কিছু মিলিয়ে বলা যায় যে, অনেক মানুষের সাহায্য আর অনুপ্রেরণা ছিল এখন পর্যন্ত। ইচ্ছা অথবা সময় হলে ঘুরে আসতে পারেন আমার ব্লগ (www.aribidopsis.com) থেকে।

আমি তো একা না

"Sometimes you meet people for the season, Sometimes you meet people for the reason" - এটা Master of None টিভি সিরিজে আজিজ আনসারির একটা অসাধারণ ডায়ালগ।
জীবনে যেখানেই গিয়েছি, যাদেরকে পেয়েছি - সবাইকে এই দুইটা দলে সহজেই ভাগ করা যায়। আর কাউকে যদি আসলেই কোন "reason" এ পেয়ে থাকি তা সহজেই অনুভব করা যায়। বলা বাহুল্য, বাকিরা হারিয়ে যায় সময়ের সাথে - কারণে আর অকারনে। আর এই ছোট "reason" এর দলে আছে মূলত পরিবার আর কাছের কিছু বন্ধুরা। এই কারনেই সামাজিক রীতিনীতির সংজ্ঞা না মেনেও জীবন আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলার মত।
The Office টিভি সিরিজের বস মাইকেলের ভাষায় বললেঃ "It's not about horniness, It's all about loneliness." যার খুব ছোট পরিসরে হলেও এই "reason" ক্যাটাগরিটা লাইফে আছে, সে একা না।

প্রফেসর আশিকারি

প্রফেসর আশিকারিকে নিয়ে লিখবো লিখবো করে প্রায় ২ বছর কালক্ষেপণ করে ফেলেছি। ২০১৬ সালের মার্চ মাসের কথা। জেএসপিপি কনফারেন্সে আমার বস একটা সেশনের আয়োজন করে। ইথিলিন নিয়ে। সেই সেশনে কয়েকজন বিগ শট প্রফেসর ছিল। আশিকারি তাদের মাঝে একজন। সেশনের ৫ জন স্পীকার, আমার বস, একজন পোস্টডক আর আমাদের ল্যাবের আমি আর আরেকটা মেয়ে, আমরা একটা ডিনার পার্টিতে যাই। সেই ডিনার পার্টিতে আশিকারি উনার স্টুডেন্ট লাইফের একটা গল্প বলে আমাদের। উনি স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায়, উনার আর্থিক অবস্থা খুব একটা সুবিধার ছিল না। উনি রাতের বেলা একটা কনভেনিয়েন্ট স্টোরে পার্ট টাইম হিসেবে কাজ করতেন। পার্ট টাইম জব করা জাপানিজ স্টুডেন্টদের মাঝে খুবই কমন ঘটনা। সেটা বিশাল কোন কিছু না। কিন্তু, এই জব থেকে সে যে টাকা পেতো, সেটা তার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। সে খেয়াল করতো, প্রতি রাতের শেষে মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার গুলো তাদেরকে বলা হত ফেলে দিতে। ঐ সব লাঞ্চ/ডিনার বক্সগুলো ভালোই থাকতো, শুধু মাত্র খাবারের ফ্রেসনেসের জন্য তা ফেলে দিতো তারা। সে সবার সাথে খাবার বক্স গুলো ফেলে দেয়ার পর, কাজ শেষ করে বাসায় যাওয়ার সময় ঐ ময়লার ঝুড়ি থেকে খাবার বক্স নিয়ে যেতো। কিন্তু মুশকিল হল জাপানিজরা অনেক লাজুক জাতি। সবার মত তারও মনের মাঝে কাজ করত, কেউ যদি কখন দেখে ফেলে, তাহলে তো সর্বনাশ। নিজের পরিচয় গোপন করার জন্য সে একটা হেলমেট কিনল। বাইকের হেলমেট। সে ঐ বাইকের হেলমেট পড়ে ময়লার ঝুড়ি থেকে খুব সাবধানে খাবার বক্স তুলে নিয়ে আসতো। অনেকেই খেয়াল করলো বিশ্ববিদ্যালয়ে, সে চালায় সাইকেল, কিন্তু সে বহন করে মোটরবাইকের হেলমেট। কেউ ব্যাপারটা মিলাতে পারতো না, সে ও কাউকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারতো না।
মাঝে অনেক বছর চলে গেছে। আশিকারি এখন জাপানে যারা প্ল্যান্ট সায়েন্সে কাজ করে তাদের মধ্যে তাকে টপ ৫ বলা যায়। ন্যাচার, সায়েন্স নিয়মিত পাবলিশ করে। যখন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রেন্ডরা এখন শুনে, সে ন্যাচার, সায়েন্স পাবলিশ করে, তারা বলেঃ “আরেহ, এইটা ঐ আশিকারি না, যে মোটর বাইকের হেলমেট পড়ে সাইকেল চালাত।”
জীবনে কোন কিছুই তেমন প্ল্যান মাফিক হয় না। খারাপ সময় আসে। ঐ সময় ধৈর্যের পরিচয় দেয়াটাই সাফল্যর পূর্ব শর্ত। কারণ, সময়ের সাথে সাথে অনেক পূর্ববর্তী বিপদ হারিয়ে যায়। নতুন চ্যালেঞ্জ আসে। আর নিজের খারাপ সময়ের কথা বলে, সেটা নিয়ে মজা করে, মানুষকে অনুপ্রাণিত করা জিনিয়াসদের ক্যারেক্টার।